প্রতি মাসের ন্যায় প্রায় অর্ধ শতাব্দিকালের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে গত ২২ কার্তিক ১৪২১ বাংলা; ১২ মহররম ১৪৩৬ হিজরী; ৬ নভেম্বর ২০১৪ ইংরেজী; বৃহস্পতিবারে রাহে ভান্ডার কধুরখীল দরবার শরীফে নিয়মিত মাসিক ফাতেহা অনুষ্ঠান পরিপূর্ণ ধর্মীয় মর্যাদায় পালন করা হয়।
এ ফাতেহায় যোগদানের জন্য মাগরিবের আগে থেকে দরবারে ভক্ত মুরিদগণের সমাগম ঘটতে থাকে। মাগরিবের সালাতের পর নিখিল মানব প্রেমাষ্পদ; আজাদে মোজাদ্দেদ- এ- জমান হযরত মৌলানা ছুফী ছৈয়দ মোহাম্মদ আব্দুল মালেক শাহ্ রাহে ভান্ডারী (কঃ) এর পবিত্র রওজায় আশেক ভক্তরা মিলাদ ও কিয়ামে অংশগ্রহণ করেন। বাদে এশা সকলের মাঝে তবারুক বিতরণ করা হয়।
ফাতেহার অছিয়ত ও নছিহত মাহফিলে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন রাহে ভান্ডার কধুরখীল দরবার শরীফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন হযরত মৌলানা ছুফী ছৈয়দ জাফর ছাদেক শাহ্ আল-রাহে ভান্ডারী (মাঃজিঃআঃ)। এতে বিশেষ অতিথিগণের মধ্যে হযরত মৌলানা ছুফী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম রফু (মাঃ), দরবারের নায়েবে মোন্তাজেম ডাঃ শাহজাদা ছৈয়দ আরেফ হোছাইন, নায়েবে সাজ্জাদানশীন হযরত ছৈয়দ মশিউর রহমান রাহাত, ছুফী মোহাম্মদ ইউসুফ, ছুফী আমিনুল ইসলাম ফকির, রাহে ভান্ডার তরুণ আশেকান পরিষদের সভাপতি শাহজাদা সাইফুল আলম নাইডু, রাহে ভান্ডার তরুণ আশেকান পরিষদ সীতাকুন্ড শাখার উপদেষ্টা শফিউল ইসলাম সহ প্রমূখ উল্লেখযোগ্য।
ফাতেহার মূল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সার্বজনীন উৎসব ‘নবী দিবস’ ও ‘মহাত্মা সম্মেলন’ এর প্রবর্তক ‘তরিকায়ে রাহে ভান্ডার’ এর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “রাহে ভান্ডার যুগের চাহিদা, সময়ের প্রয়োজন। ‘কুনতুকানজান মাখফিয়ান’- এই গুপ্ত রহস্যের ভান্ডারের যে পন্থ, তা-ই রাহে ভান্ডার। রাহে ভান্ডার এর প্রতিষ্ঠাতা, দুলহা-এ হযরত, ছাহেবুল অজুদুল কোরআন, গাউছুল আজম হযরত মৌলানা ছুফী ছৈয়দ ছালেকুর রহমান শাহ রাহে ভান্ডারী রাজানগরী (কঃ), যিনি জাগতিক ভাবে আরবী, উর্দূ, ফারসী- সকল জ্ঞানে জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। উনি স্বয়ং উনার দরবারের নামকরণ করেন ‘রাহে ভান্ডার’। এই যে নামকরণ, শুধু নামকরণ নয়, উনার শিক্ষা-দীক্ষাও ব্যতিক্রম। গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর সকল আদর্শের মধ্যে বিশেষ আদর্শ এই রাহে ভান্ডার। এই তরিকা সচরাচর সবার পাওনা নয়। বিশেষ করে আজল যাদের উন্নত, যারা আজল থেকে প্রাপ্ত, তারাই এই তরিকায় অংশগ্রহণ করবে”।
রাহে ভান্ডার দর্শনের আদর্শ ও মূল্যবোধের বর্ণনায় বর্তমান দীক্ষা গুরুর প্রাঞ্জল উপস্থাপনা, “এখানে মানবের মূল্যায়ন হয়, মানবতার মূল্যায়ন হয়। মানব কল্যাণে ধর্ম ব্যবহার এই দরবারের আদর্শ। মানবকল্যাণে ধর্ম ব্যবহৃত হবে। গতানুগতিক ধর্ম বিশ্বাসী এই দরবার নয়। এই দরবারের সকল কর্মকান্ড বিবেক প্রসূত, বিবেকহীন ধর্ম জ্ঞানে বিশ্বাসী নয়। বিবেক বুদ্ধি বিবেচনায় যা প্রমাণিত; চিরসত্য ধর্মের সদা-সর্বদা অনুসরণ এই দরবার করে এসেছে, করবে”। উদ্ভট বিবেকহীন এক শ্রেণীর তথা কথিত আলেম নামধারী মোল্লা-মুন্সিরা যুগের পর যুগ ধরে কুসংস্কার সর্বস্ব বিবেকবর্জিত আচার অনুষ্ঠানকে মূল ধর্ম প্রমাণ করতে মরিয়া। এই অপচেষ্টার অংশ হিসেবে তারা অপরের সব কিছুতে বেদআত নামের ফতোয়া জারি করতে ব্যস্ত।
মানবের জন্মগত স্বাধীনতা ও পরধর্মের প্রতি অসৌজন্য প্রদর্শনকারী কাঠমোল্লার দলের উদ্দেশ্যে রাহে ভান্ডার দরবারের সার্বিক তত্ত্ববধায়ক মহোদয়ের কথন, “রাহে ভান্ডার মূল কারিগরের কারিগরি, এটা চলতে থাকবে। রাহে ভান্ডার হলো পুরানো তরিকার নতুন রূপ। যারা বেদআতের ফতোয়া দিচ্ছে তাদের প্রত্যেকের পকেটে কি একটি করে মোবাইল ফোন নেই, যা একটি জ্বাজ্জল্যমান বেদআত? পাকা দালানে যায় না এমন মোল্লা কি পাওয়া যাবে? এখন তো বেশির ভাগ মসজিদ ইট পাথরের দালান, রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর মসজিদে নববী কি পাকা দালানের ছিল? রাসুলুল্লাহর আমলে জমজম কুপ হতে বালতি দিয়ে পানি তুলতে হতো। এখনকার হাজীরা যেখানে সেখানে জমজম এর পানি পাচ্ছেন। এমনকি তারা জমজম কুপের অস্তিত্বও জানেন না। আগেতো সবাই জমজম কুপ দেখতো। তাদের দেয়া ফতোয়া ও দলিল দস্তাবেজ অনুযায়ী কি মক্কা শরীফেও বেদআত প্রচলিত নয়?”
এসব সুবিধাভোগী দ্বিমুখী চরিত্রের লোকদের স্বভাব সম্পর্কে মন্তব্যে তিনি বলেন, “ধর্মে নতুন কিছুর সংযোজনকে বেদআত বলে সত্য; তবে এসব বেদআতে হাসনা, বেদআতে ছাইয়া নয়। যারা বেদআত থেকে তুষ্টিত-পুষ্টিত, বেদআত থেকে লাভ-লভ্য গ্রহণ করে, যারা আপাদমস্তক বেদআতে ডুবে আছে,তারাই ‘বেদআত’ ‘বেদআত’ বলে চিল্লাফাল্লা করছে। বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে এতসব যন্ত্রপাতিকে বাদ দিয়ে চলা যায় না, কেউ চলতে পারে না। বেদআতকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই”।
এসব কান্ডজ্ঞানহীন লোকদের পরিণাম সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, “নিজে কি করে তার কোন খবর নাই, শুধু অপরের দোষ তালাশ! জানিনা এদের কি পরিণতি! ওয়াল্লাহু আ’লামু ওয়া রাসুলু আ’লামু”।
হযরত মৌলানা ছুফী ছৈয়দ মোহাম্মদ আব্দুল মালেক শাহকে (কঃ) ওনার স্বীয় মুর্শিদ দুলহায়ে হযরত ছুফী মৌলানা ছৈয়দ ছালেকুর রহমান শাহ রাজানগরী (কঃ) কর্তৃক খেলাফত প্রদানের ঘটনা বর্ণনায় হযরত মৌলানা ছুফী ছৈয়দ জাফর ছাদেক শাহ্ (মাঃজিঃআঃ) আবেগাপ্লুত হয়ে ব্যক্ত করেন, “ছালেক শাহ (কঃ) যদিও তাঁর অনেক শিষ্যকে খেলাফত প্রদান করেন, আমার বাবাজান মালেক শাহ্ (কঃ) কে খেলাফত প্রদান ছিল সবার চাইতে ব্যতিক্রম। শুধু তাই নয়, ঐ সময় আমার বাবাজানের শানে তাঁর পীর ছালেক শাহ (কঃ) এই ফার্সী শায়েরীটি কালাম করেন :
সোদ আঁ নামে ছালেক শাহে বাহদর এয়াফত খেতাবী বমূলকে মালেক
বাগে খুঁদি আজব এনায়াত বাহাতে বাহাতে কিয়ায়ে আলম।।
মুর্শিদ ছালেক শাহ (কঃ) তাঁর প্রিয় শিষ্য মালেক শাহ (কঃ) কে ‘আজাদে মোজাদ্দেদ’ খেতাবে ভূষিত করেন”।
‘রাহে ভান্ডার এ্যানোবল এওয়ার্ড’ এর প্রবর্তনকারী হযরত মৌলানা ছৈয়দ জাফর ছাদেক শাহ (মাঃজিঃআঃ) তাঁর বক্তব্যের শেষ দিকে রাহে ভান্ডার দরবার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা, বিদ্বেষপোষণকারী ও বিরুদ্ধাচরণকারীদের উদ্দেশ্যে উল্লেখ করেন, “রাহে ভান্ডার ‘আপডেট’ ধর্মের চর্চা করে। ‘আপডেট’ এর অর্থ যারা বোঝেনা, তারা রাহে ভান্ডার বোঝেনা। এখানে ৩৬০ দেব- দেবীর পূজা অর্চনা করা হয় না। আমরা এক আল্লাহর ইবাদত করি”।
পরিশেষে তিনি তাঁর ভক্ত-শিষ্যদের আদব ও বিনয় সম্পর্কে বিবিধ শিক্ষামূলক কথা বলেন ও আমল করার তাগিদ দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।
আলোচনা শেষ হলে রাহে ভান্ডার ছূফী শিল্পী পরিষদের ছৈয়দ মশফিকুর রহমান ফয়সাল ও শায়ের শাহেদের পরিবেশনায় ছেম’আ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে সাথে নিয়ে পৃথিবী ব্যাপী মুসলিম উম্মাহর বর্তমান দুরাবস্থা হতে উত্তরণ, উম্মতে মোহম্মদীর মধ্যে পারস্পরিক ভাতৃত্ববোধ, মমতা ও সহানুভূতি বৃদ্ধি, সমগ্র মানব জাতীর হেদায়েত, সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মোনাজাত করেন হযরত মৌলানা ছুফী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম রফু (মাঃ)।
লেখক: মুহাম্মদ জিফাদ বিন লিয়াকত
...